সেই অভিযুক্ত আওয়ামীলীগ নেতারা আবার ফিরছে এনআরবিসি ব্যাংক
বিশেষ প্রতিনিধি
ব্যাংক শুরু হওয়ার আগেই কেনাকাটার নামে অর্থলোপাট, বেনামে শেয়ার বিক্রি ও কার্যক্রমের শুরুতেই ঋণের নামে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার মত গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত প্রবাসী আওয়ামীলীগ নেতারা আবার ফিরছে এনআরবিসি ব্যাংক। তাঁরা হলেন ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান ও যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ফরাসত আলী, সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি তৌফিক রহমান চৌধুরী এবং যুক্তরাষ্ট্র যুবলীগের নেতা সরোয়ার জামান চৌধুরী। ব্যাংক থেকে ৮০০ কোটি টাকা লোপাট, পরিচালকদের স্বাক্ষর জালিয়াতি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে মিথ্যা তথ্য প্রদানের জন্য সাবেক চেয়ারম্যানসহ কয়েকজন পরিচালককে শাস্তি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এদিকে ব্যাংক শুরু হওয়ার আগেই ভুয়া বিল ভাউচার তৈরি করে অর্থ লোপাটের অভিযোগ তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
আওয়ামীলীগ নেতাদের দুর্নীতির তদন্ত করতে এবং পরিচালক হিসেবে নিয়োগ না দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ সংশ্লিষ্ট ডেপুটি গভর্নর, নির্বাহী পরিচালক, পরিচালকের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন ব্যাংকের তিনজন উদ্যোক্তা পরিচালক। ব্যাংকের পরিচালক ও রিস্ক ম্যানেজমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান একেএম মোস্তাফিজুর রহমান, পরিচালক লকিয়ত উল্ল্যাহ, উদ্যোক্তা ও সাবেক পরিচালক সাইদুর রহমান স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামীলীগ নেতা ইঞ্জিনিয়ার ফরাসত আলী ২০১৩ সালে চালু হওয়া এনআরবিসি ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০১৩ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত চেয়ারম্যান পদে থেকে ব্যাংকের ৮০০ কোটি টাকা ঋণের অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। প্রবাসীদের নাম ব্যবহার করে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের নামে শেয়ার ধারণের সুযোগ, প্রবাসীদের স্বাক্ষর জাল করে অ্যাকাউন্ট খোলা, সভায় উপস্থিতি দেখানো, ভূয়া নথি তৈরি করে ঋণের নামে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। এ ব্যাংকে বড় ধরনের অনিয়ম ধরা পড়ায় ২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়। সে সময় ফরাছত আলীকে চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় দীর্ঘ শুনানি শেষে ২০২০ সালে তাকে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই নিষিদ্ধের মেয়াদ শেষ হওয়ায় আবার এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদ ফিরে পেতে অপতৎপরতা শুরু করেছেন। গত বছরের জুলাই বিপ্লবে ছাত্রজনতা বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে প্রকাশ্যে আন্দোলনে নামেন আওয়ামীলীগের এই নেতা। তার নেতৃত্বে গত বছরের ২২ জুলাই নিউইয়র্কে আওয়ামীলীগের সহযোগী সংগঠন ও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির ব্যানারে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশ হয়। ওই সমাবেশ থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলা করা হয়। ওই হামলা জড়িত ছিলেন এনআরবিসি ব্যাংকের আরেক উদ্যোক্তা যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামীলীগ নেতা সাখাওয়াত আলী।
দুদকে দাখিল করা অভিযোগ সূত্র জানায়, ২০১৩ সালে ২ এপ্রিল যাত্রা শুরুর আগে ব্যাংকের ১ ও ২য় বোর্ড মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। কিছু পরিচালককে আমন্ত্রণ না জানিয়ে অনেকটা গোপনে ওই বোর্ড মিটিংয়ের আয়োজন করা হয়। ওই মিটিংয়ের ব্যাংক প্রতিষ্ঠানর জন্য সাজসজ্জা এবং আইটি সফটওয়ার ও হার্ডওয়ার ক্রয়ের নামে ১৭ কোটি টাকা ব্যয় অনুমোদন করা হয়। পরবর্তীতে ভুয়া বিল ভাউচার প্রদান করে ওই অর্থ আত্মসাৎ করেন তৎকালীন চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার ফরাসত আলী এবং সাবেক পরিচালক সরোয়ার জামান চৌধুরী। এসব দুর্নীতিতে তার সহযোগী ছিলেন তৎকালীন এমডি দেওয়ান মুজিবুর রহমান, বেনামী শেয়ারহোল্ডার শহীদুল আহসান, এনায়েত হোসেন, সুনাহার আলী প্রমুখ।
এসব অভিযোগ তদন্তে দুদকের উপপরিচালক আফরোজা হক খানকে প্রধান করে দুই সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটি গত ১৯ জানুয়ারি এনআরবিসি ব্যাংকে চিঠি পাঠিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার ফরাছত আলী, সাবেক পরিচালক সরোয়ার জামান চৌধুরী, সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ এনায়েত হোসেনের বিরুদ্ধে ভুয়া বিল-ভাউচার তৈরি করে ব্যাংকের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ, হুন্ডির ব্যবসা, ঋণ প্রদানে অনিয়মের মাধ্যমে শত শত কোটি আত্মসাৎ এবং বিদেশে অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত প্রয়োজন। তাই কমিটির কাছে আগামী ২৮ জানুয়ারির মধ্যে একাধিক তথ্য প্রদানের জন্য বলা হয়েছে ব্যাংকটিকে। এর মধ্যে রয়েছে, ২০১৩, ২০১৪ এবং ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত পর্ষদ সভার রেজুলেশন ও হাজিরা শিটের সত্যায়িত কপি। এজি অ্যাগ্রো, বেগমগঞ্জ ফিড মিলস, স্টাইলিশ গার্মেন্টস, ব্যাংকের উত্তরা শাখার গ্রাহক আজিজসহ আরও দুজনের নামে গৃহীত ঋণের নথি বিস্তারিত চাওয়া হয়েছে। ২০১৩, ২০১৪, ২০১৫ এবং ২০১৬ সালের পরিচালনা পর্ষদের বর্তমান কর্মস্থলসহ বিস্তারিত চাওয়া হয়েছে। এছাড়াও ২০১৫-১৬ এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ব্যাংকের মোট মূলধনের পরিমাণ এবং পাঁচজন বড় ঋণগ্রহীতার ঋণের বিবরণ প্রদানের জন্য বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, ৫৩ জন প্রবাসীর নামে এনআরবিসি ব্যাংকের লাইসেন্স দেয় সরকার। কিন্তু বাংলাদেশে বসবাসরত কতিপয় ব্যবসায়ী জালিয়াতি করে প্রবাসীদের নাম ব্যবহার করে নিজেরা এনআরবিসি ব্যাংকের উদ্যোক্তা বনে যান। এজন্য তারা বাংলাদেশ থেকে প্রথমে অর্থপাচার করে দুবাই, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইতালি নিয়ে যান। আবার ওই সব অর্থ প্রবাসীদের নাম ঠিকানা ব্যবহার করে রেমিটেন্স হিসেবে বাংলাদেশে পাঠিয়ে এনআরবিসি ব্যাংকের শেয়ার কেনা হয়। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী কামরুন নাহার সাখীর নামে শেয়ার কেনেন মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যার শহীদুল আহসান। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আমির হোসেনের নামে শেয়ার কেনেন আরেক ব্যবসায়ী আরএসআরএম গ্রুপের মাকসুদুর রহমান। এনায়েত হোসেনের ব্যবহার করে উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডার হোন সেভেন রিংস গ্রুপের খান মুজিবুর রহমান। যুক্তরাজ্য প্রবাসী সুনাহার আলীর নামে শেয়ার কেনেন আওয়ামীলীগের প্রয়াত সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ। সরোয়ার জামান চৌধুরীর নামে থাকা শেয়ারের প্রকৃত মালিক মামুন মুছা মিয়া।এছাড়া তৎকালীন চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার ফরাসত আলী প্রিমিয়ামের টাকায় নিজের পরিবারের ১৬ জন সদস্যদের নামে ব্যাংকের শেয়ার কিনেছেন। যদিও ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুসারে একক পরিবারের সদস্যদের নামে ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার কেনার সুযোগ ছিল না। এছাড়া প্রবাসীদের জন্য ব্যাংকটির লাইসেন্স দেওয়া হলেও প্রথম পরিচালনা পর্ষদের ২০ জন সদস্যের মধ্যে ১২ জনই প্রবাসী ছিলেন না। ভুয়া কাগজপত্র দাখিল করে এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তারা পরিচালক পদ বাগিয়ে নেন।
এছাড়া সরোয়ার জামান চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী হলেও এনআরবিসি ব্যাংকের স্পন্সর শেয়ার কেনার টাকা আসে দুবাই থেকে। ওই টাকা স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের মাধ্যমে প্রেরণ করেন তার ভগ্নিপতি মামুন মুছা মিয়া। আন্তর্জাতিক মানিল্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশে বিনিয়োগের বিষয়টি সেদেশের ট্যাক্স ফাইলে ঘোষণা করতে হয়। কিন্তু সরোয়ার জামান চৌধুরী তা করেননি। এটি মানিলন্ডারিং এবং অর্থপাচারের অপরাধ।
বাংলাদেশ বাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কামরুন নাহার সাখী এনআরবিসি ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন কিন্তু কোনদিন বাংলাদেশে আসেননি। তার হয়ে পর্ষদে উপস্থিত থাকতেন শহীদুল আহসান নিজে এবং তিনি কামরুন নামে স্বাক্ষর করতেন। শহীদুল আহসান পরিচালনা পর্ষদের উপস্থিত থেকে নিজের নামে ৩০০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করিয়ে নেন। বেনামে ঋণ পাইয়ে দিতে তাকে সহযোগিতা করনে তৎকালীন চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার ফরাসত আলী ও অন্য পরিচালকরা।
গত ২০১৬ ও ২০১৭ সালে এসব তদন্তে এসব অভিযোগের প্রমাণ পায় বাংলাদেশ ব্যাংক। তৎকালীন এমডি দেওয়ার মুজিবুর রহমানকে অপসারণ করা হয়। চেয়ারম্যানসহ ৬ পরিচালককে সরিয়ে পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয় এবং চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার ফরাসত আলীকে ২ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। এখন আবার সেই বিতর্কিত সাবেক তিন পরিচালককে পর্ষদে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনআরবিসি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। গত ২১ জানুয়ারি ব্যাংকের ১৯৫তম পর্ষদ সভায় এই তিনজনের নিয়োগ অনুমোদন করা হয়। গত বছরের জুলাইয়ে ফরাসত আলীর স্ত্রী শাহানারা বেগম আলী ব্যাংকটির পরিচালক হন; কিন্তু এখন ফরাসত আলী নিজে পর্ষদে যোগদানে আগ্রহী হওয়ায় সম্প্রতি তার স্ত্রীকে পরিচালক থেকে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ইঞ্জিনিয়ার ফরাসত আলী, তৌফিক রহমান চৌধুরী ও সরোয়ার জামান চৌধুরী তিনজনই যুক্তরাষ্ট্র এবং সিলেট জেলা আওয়ামীলীগের নেতা এবং তাদের বিরুদ্ধেই ছিল ব্যাংকটিতে নানা অনিয়মের অভিযোগ।
এই তিনজনকে নতুন করে পরিচালক করার বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (চলতি দায়িত্বে) রবিউল ইসলাম বলেন, ‘নতুন করে তিনজন উদ্যোক্তাকে পরিচালক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন পাওয়া গেলেই তাঁদের নিয়োগ চূড়ান্ত হবে। দ্রুতই পর্ষদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন চেয়ে আমরা চিঠি পাঠাব।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক ও সহকারী মুখপাত্র মোহাম্মদ শাহরিয়ার সিদ্দিকী বলেন, এনআরবিসি ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগ সংক্রান্ত আবেদন এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আসেনি। আবেদন পেলে দেখা যাবে।