ক্রিকেটের ‘মব জাস্টিস’ তাহলে এ রকম
আগামী প্রিমিয়ার লিগে কি তাওহিদ হৃদয় মোহামেডানেই খেলবেন? যদি খেলেন, তাঁর এক ম্যাচের বকেয়া নিষেধাজ্ঞাও মোহামেডানের ওপর দিয়ে যাবে। প্রশ্নটা হলো, যদি কোনো কারণে মোহামেডানে তিনি না খেলেন, তখন কী হবে?
কোনো দল কি এটা জেনেও হৃদয়কে দলে নেবে যে লিগের প্রথম ম্যাচেই তাঁকে মাঠে নামানো যাবে না? এক ক্লাবের হয়ে মাঠে অসদাচরণ করে পাওয়া তাঁর শাস্তি এক বছর পর আরেক ক্লাব ভোগ করবে কি? করবে হয়তো, জাতীয় দলের ক্রিকেটার যেহেতু…।
প্রশ্ন আসলে সেটাও না। প্রশ্ন হলো, এক মৌসুমের অপরাধের শাস্তি আরেক মৌসুমে গিয়ে কেন দিতে হবে, যখন এ মৌসুমেই সংশ্লিষ্ট দল মোহামেডানের আরও দুটি ম্যাচ বাকি? এটা কি একটি নির্দিষ্ট দলের প্রতি স্পষ্ট পক্ষপাতিত্ব নয়? যেই ক্লাব হৃদয়কে আগামী লিগে দলে নেবে, তাদের প্রতিও অগ্রীম অন্যায় করে রাখা হলো না এতে?
এ উদাহরণ সামনে রেখে ভবিষ্যতে যদি অন্য কোনো ক্লাব বা ক্রিকেটারও এমন সুবিধা চায়, কোন মুখে বিসিবি তাদের ‘না’ করবে? ঐতিহ্যবাহী মোহামেডানই–বা কীভাবে বলবে, ‘আমরা এটা মানি না!’ বরং ভবিষ্যতে যতবার এ–জাতীয় সমস্যায় আক্রান্ত হবে বাংলাদেশের ক্রিকেট, যতবার আলোচনা হবে আইসিসির এলিট আম্পায়ার শরফুদ্দৌলা ইবনে শহীদের ক্ষোভ–অপমানজনিত পদত্যাগ নিয়ে, ঠিক ততবারই দেশের ক্রিকেটের এসব কলঙ্কের সঙ্গে উচ্চারিত হবে ‘ঐতিহ্যবাহী’ মোহামেডানের নাম।
সঙ্গে আরও কিছু নামও উচ্চারিত হবে, যেগুলো ঘটনা পরম্পরায় সবাই জানেন অথবা জেনে যাবেন।
টেকনিক্যাল কমিটির দায়িত্ব নিয়ে নাজমূল আবেদীন বলেছেন, ভবিষ্যতে লিগের বাইলজ কঠোরভাবে প্রতিপালন করা হবে। তা সঠিক কাজটা ভবিষ্যতের জন্য রেখে দিয়ে এবার কেন জেনেশুনে বেঠিক কাজটাই করা হলো? বাইলজ তো এখনো আছে। সেটা মানলেন না কেন আপনারা? অন্যদের মানতে বাধ্য করছেন না কেন? কোথায় আপনাদের দুর্বলতা?
সাবেক এমপি নাজমুল হাসানের বোর্ডের অনেক দুর্নাম ছিল। এই বোর্ডের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা তখনকার বোর্ডকে যেকোনো সুযোগে সমালোচনাবিদ্ধ করেছেন। বিস্ময়কর হলেও সত্যি, এখন সেই সমালোচকেরাই একের পর এক ‘চমক’ দেখিয়ে যাচ্ছেন বোর্ডে এসে।
বর্তমান বোর্ড নতুন করে গঠিত হওয়ার পর গত আট-নয় মাসে যত বিতর্ক আর অকাণ্ডের জন্ম দিয়েছে, একটি করে বিপিএল-প্রিমিয়ার লিগেই যত অনিয়মকে ‘নিয়ম’ বানিয়েছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চরম বিতর্কিত হয়ে পড়া নাজমুল হাসানের বোর্ডও অন্তত তাদের প্রথম এক বছরে এতটা লোক হাসায়নি।
বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদের কাছে কাল কয়েক দিন ধরে চলমান একের পর এক হৃদয়ঘটিত চাঞ্চল্যের ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছিলাম। তবে এ ব্যাপারে কোনো দায়িত্ব না নিয়ে ফারুক বলেছেন, ‘এটা টেকনিক্যাল কমিটির ব্যপার। টেকনিক্যাল কমিটি স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেবে, এটাই নিয়ম। এখানে সভাপতি হস্তক্ষেপ করতে পারে না। তাঁরা কী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, কেন নিয়েছেন, সেটা কমিটির সদস্যরাই ভালো বলতে পারবেন।’
ফারুক আহমেদের কথায় যুক্তি আছে, তবে উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে মুক্তি দিচ্ছে না তাঁর যুক্তি। কারণ, হৃদয়ের ঘটনা এরই মধ্যে সেই ‘স্বাধীন কমিটি’কেও প্রচণ্ডভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে।
শাস্তি কমানোর চাপ উড়িয়ে দিতে কমিটির আগের প্রধান ও সাবেক আন্তর্জাতিক আম্পায়ার এনামুল হক পদত্যাগ করেছেন। নতুন প্রধান হযেছেন নাজমূল আবেদীন, যিনি আবার বিসিবিরও পরিচালক। বোর্ড পরিচালক হয়ে তিনি টেকনিক্যাল কমিটি প্রধানের দায়িত্ব নিতে পারেন কি না, সেই ধোঁয়াশার মধ্যেই কাল প্রথম সুযোগে নাজমূলের ‘স্বাধীন কমিটি’ একটি ‘পরাধীন’ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।
হৃদয়ের আজকের ম্যাচ খেলায় যে নিষেধাজ্ঞাটি থাকার কথা ছিল, একদল ক্রিকেটারের চাপে পড়ে ২৪ ঘণ্টার কম সময়ের মধ্যে অবস্থান বদলে কাল তা এক বছর পিছিয়ে দিয়েছে তথাকথিত ‘স্বাধীন’ টেকনিক্যাল কমিটি। বোর্ডের ওপর সেই চাপ প্রয়োগ করা ক্রিকেটারদের নেতৃত্বে আবার ছিলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ছেড়ে সংগঠক ক্যারিয়ার গড়ায় মনোনিবেশ করা তামিম ইকবাল।
ভেবে অবাক লাগে, বাংলাদেশের বাস্তবতায় অপেক্ষাকৃত কম ক্ষমতাশালী এনামুল হক যে সাহস দেখিয়েছেন, বিসিবির পরিচালক হিসেবে প্রভাবশালী বলে পরিচিত এবং ক্রিকেটের একজন নিখুঁত টেকনিক্যাল মানুষ হয়েও নাজমূল আবেদীন সেটি দেখাতে পারেননি! তাঁর নেতৃত্বে ‘স্বাধীন’ কমিটিও হয়ে গেছে ‘পরাধীন’। স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা ধরে রাখা যে আসলেই কঠিন, এ ঘটনা তার বড় উদাহরণ হয়েই থাকবে।
আরেকটি কথা না বললেই নয়। বাংলাদেশের ক্রিকেটে অনেক দিন পর এমন একটি ঘটনা ঘটল, যেখানে কোনো পক্ষই সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমীদের সমর্থন পাচ্ছে না। তবে আত্মসম্মান বাঁচাতে যার যার দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়া শরফুদ্দৌলা ও এনামুল এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম।
কাল দুপুরে তামিমের নেতৃত্বে জাতীয় দলে খেলা ও না–খেলা ক্রিকেটারদের বিশাল দলটি যখন বিসিবি সভাপতির সঙ্গে তাঁর কার্যালয়ে সাক্ষাৎ করে, তখন সেখানে নাজমূল আবেদীনও ছিলেন, আর ছিলেন বিসিবির আম্পায়ার্স কমিটির প্রধান ইফতেখার রহমান। খেলোয়াড়দের মূল দাবি ছিল হৃদয়ের শাস্তি প্রত্যাহার, মাহমুদুল্লাহর মতো কেউ কেউ নাকি আবার বলেছেন, এক ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা এক বছর পিছিয়ে দিলেও চলবে।
কী বিস্ময়কর, তা–ই না! এত বছর ধরে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যায়ে খেলা একদল ক্রিকেটারের পক্ষে সজ্ঞানে কী করে সম্ভব হলো একজন ক্রিকেটারের মাঠের অখেলোয়াড়োচিত আচরণের দায়ে পাওয়া শাস্তি প্রত্যাহারের জন্য বোর্ডকে এভাবে চাপ দেওয়া? আচরণবিধি ভঙ্গের ধারা, শাস্তি—এসব খেলাটার আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনেই হয় সবখানে। আপনি এক জায়গায় তা মানলেন না মানে কোনো জায়গাতেই তা মানলেন না। তাহলে এত বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলে কী শিখলেন আপনারা, কীই–বা শেখালেন আপনাদের ছোট ভাইদের? বিসিবি অতি উদার কিংবা নতজানু না হলে মাঠের শাস্তির প্রতিবাদে ক্রিকেটারদের এমন ‘গণ–আন্দোলন’ গড়ে তোলাকেও আচরণবিধিভঙ্গের আওতায় ফেলতে পারত।
তামিম অবশ্য দলবল নিয়ে বোর্ডে যাওয়ার আরও দুটি কারণের কথা বলেছেন। এক. প্রিমিয়ার লিগের এক ম্যাচের একটি সন্দেহজনক আউটের তদন্ত করতে গিয়ে বিসিবির দুর্নীতি দমন বিভাগের হাস্যকর কর্মকাণ্ড এবং দুই. বিপিএলে স্পট ফিক্সিংয়ের সন্দেহভাজনদের নাম দোষী প্রমাণিত হওয়ার আগেই প্রকাশ হয়ে যাওয়া। তামিমের ভাষ্য অনুযায়ী সব মিলিয়েই নাকি তাঁদের বোর্ড সভাপতির কাছে যাওয়া।
কিন্তু ওপরে যে দুটি কারণের কথা বলা হলো, সেগুলোর ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া দেখাতে কি একটু দেরিই করে ফেললেন না ক্রিকেটাররা, বিশেষ করে যখন এসব নিয়ে সংবাদ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সরব হয়েছে আরও আগেই? বাকি থাকে হৃদয়ের প্রসঙ্গ। কিন্তু তার জন্য তো মোহামেডান খেলোয়াড়দের সঙ্গে গলা জড়িয়ে অন্য ক্লাবের খেলোয়াড়দের যাওয়ার কথা নয়! ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে এত মহব্বত কবে চালু হলো?
মিরপুরের এসব ঘটনায় চোখ রাখতে রাখতে কাল বারবার মনে পড়ছিল সাম্প্রতিককালে যারা রাস্তা বন্ধ করে দাবি আদায়ের সংস্কৃতি চালু করেছেন, তাঁদের কথা। আর মনে পড়ছিল ‘মব জাস্টিসের’ কথা।
ক্রিকেটাররা রাস্তা আটকাননি, মব জাস্টিসেও নামেননি। তবে ক্রিকেটীয় রীতিনীতি-শিষ্টাচার ভেঙে শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে আন্দোলনের যে মহড়া তাঁরা দিলেন এবং যেভাবে অন্যায় দাবি আদায় করলেন, সেটি বিসিবির শীতাতপনিয়ন্ত্রিত আধুনিক অন্দরসজ্জার বোর্ড রুমের অ্যারিস্টোক্র্যাটিক আবহে বলেই হয়তো একটু ভদ্রস্থ মনে হচ্ছে। নইলে সেটি তো ‘মব জাস্টিস’-এরই অন্য রূপ।