রাফিনিয়ার পাস থেকে গোল করে তাঁর সঙ্গে উদ্‌যাপন ইয়ামালেরএএফপি

মেসির ‘ধনুক’ পেয়েছেন ইয়ামাল

ফুটবল খেলায় ‘ঈশ্বরের’ অভাব নেই। ব্রাজিলে যেমন পেলে, আর্জেন্টিনায় তেমনি ডিয়েগো ম্যারাডোনা কিংবা লিওনেল মেসি। পর্তুগালে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো অথবা ইউসেবিও। ভক্তরা তাঁদের এমন চোখে দেখে শান্তি পান। তেমনই বার্সার ভক্তরা মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর বিখ্যাত ফ্রেসকো ‘দ্য ক্রিয়েশন অব অ্যাডাম’ দেখে একটি বিষয় মিলিয়ে নিতে পারেন। আরে! লামিনে ইয়ামাল ও লিওনেল মেসিকে নিয়ে যেমনটা ভাবা হয়, এ ছবি তো তেমনই!

বার্সার অনেক সমর্থকের চোখেই ইয়ামালের ‘গডফাদার’ মেসি। শুধু খেলার ধাঁচে কিংবা গোল করার ঢঙে নয়, ভাগ্যও যেন জীবনের একটি পথে দুজনকে ‘দ্য ক্রিয়েশন অব অ্যাডাম’–এর মতো মিলিয়ে দিয়েছে! কীভাবে? অ্যাঞ্জেলোর ছবিতে দেখা যায়, পৃথিবীর বাসিন্দা আদমের আঙুল ছুঁচ্ছেন সৃষ্টিকর্তা, প্রাণদান করছেন স্বর্গ থেকে। মানুষের সঙ্গে সৃষ্টিকর্তার যোগাযোগের ইঙ্গিতপূর্ণ সে ছবি। তেমনি রূপক অর্থে শিশু বয়সের ইয়ামালকে মেসির গোসল করানোর ছবি কি সেই ফ্রেসকোর চেয়ে খুব আলাদা?

আধ্যাত্মিকতাবাদে বিশ্বাসী বার্সা সমর্থকেরা কিন্তু বলতেই পারেন, বাচ্চা বয়সে মেসির স্পর্শধন্য ও অগ্নিস্নানে শুচি হয়েই তো প্রাণ পেয়েছে ইয়ামালের খেলা!

তা মেসির কাছ থেকে অনেক কিছু পেয়েছেনও ইয়ামাল। বাঁ পা’টা দুজনেরই ক্ষুরধার, আক্রমণটা শুরু করেন ডান উইং থেকে, তারপর কাট ইন করে বাঁ পায়ের বাঁকানো শট এবং বলটি ধনুকের মতো বাঁক নিয়ে আশ্রয় নেয় জালে। একদম নিকট অতীত মনে পড়ল বুঝি? হ্যাঁ, কাল রাতে বেনফিকার বিপক্ষে ঠিক এমনই এক গোল করেন ইয়ামাল। লোকে তা দেখে স্মরণ করেছে মেসিকে। ‘দ্য ক্রিয়েশন অব অ্যাডাম’–এর মতো ইয়ামালও যেন ‘ক্রিয়েশন অব নিউ মেসি’। অতীতে ‘নতুন মেসি’ তকমা পেয়েছেন আরও অনেকেই। কিন্তু ইয়ামালের মতো যথার্থ হতে পেরেছেন কজন?

মেসির মতো সামনে হয়তো আরও অনেকেই আসবেন, কিন্তু ১৭ বছর বয়সী এই ছেলেটিই আসলে প্রথম নতুন মেসি!

এখনো টাটকা স্মৃতি, কাল রাতে চ্যাম্পিয়নস লিগ শেষ ষোলো ফিরতি লেগের উদাহরণ টানা যায়। ১১ মিনিটে রাফিনিয়াকে দিয়ে গোল করানোর সময়ও হয়তো কেউ ভাবেননি, এরপরই ইয়ামালের ঝুলি থেকে ম্যাচের সেরা ছবিটি বের হবে। তাঁর গোল বানানোর চার থেকে পাঁচ মিনিট পর কিছুক্ষণ থেমেছে খেলা। কিছু সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, ইফতার–বিরতি। ইয়ামালসহ দুই দলের কয়েকজন খেলোয়াড় তখন ইফতার সেরে নিয়েছেন। স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম মার্কা অবশ্য জানিয়েছে, ‘সূর্য ডোবার সময় রেফারি ইয়ামালের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, তিনি কিছু খেতে বা পান করতে চান কি না, ইয়ামাল রাজি হননি। কারণ, তাঁর চাওয়া ছিল শুধুই খেলা।’

তবে ইয়ামালকে তখন কিছু একটা পান করতে দেখা গেছে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেই ছবিও ছড়িয়ে পড়েছে। কোনো সংবাদমাধ্যমই ব্যাপারটি পুরোপুরি নিশ্চিত করতে না পারলেও রোজা নিয়ে নিজের ভাবনা দাজান স্পেনকে বলেছেন ইয়ামাল। নিজ ধর্মে তাঁর বিশ্বাস আছে। নিজেকে রোজা রাখার মতো স্বাস্থ্যবান বলে মনে করেন। ভোর পাঁচটায় উঠে নামাজের আগে ইলেকট্রোলাইটসমৃদ্ধ পানীয় পান করেন। কারণ, সারা দিন তা পানির অভাব পূরণ করে।

রাফিনিয়ার (গোলের) অভাব পূরণ করে ইয়ামাল ভেবেছেন নিজেরটি। ২৭ মিনিটে ডান প্রান্তে বল পেয়ে বেনফিকার এক ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে বক্সের একটু বাইরে থেকে কোনাকুনি যে শটটি নিলেন ইয়ামাল, সেটা দেখে মেসিকে মনে পড়বেই—বার্সা ক্যারিয়ারে এমন প্রচুর গোল আছে মেসির—বলটি তীব্রগতিতে বাতাসে বাঁক নিয়ে আশ্রয় নিল জালে! দূরত্ব বিবেচনায় অবিশ্বাস্য এক গোল, যেটা আপনাকে মনে করিয়ে দিতে পারে গত ইউরোর সেমিফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে ইয়ামালের গোলটিকে। ম্যাচ শেষে মুভিস্টারকে সে কথা তিনি নিজেই বলেছেন, ‘ইউরোয় যে গোলটি করেছিলাম, এটা সেটার মতোই।’

সতীর্থের গোল নিয়ে রাফিনিয়ার উক্তি, ‘ইয়ামালের গোলটি অসাধারণ! এটা বুঝিয়ে দেয় সে কোন মাপের। অসাধারণ গুণাবলিসম্পন্ন এক খেলোয়াড়।’

ইয়ামালের গুণে মুগ্ধ হয়েই সম্ভবত তাঁর গোলের পর একটি কাজ করেছেন রাফিনিয়া। ইয়ামালের বাঁ পায়ের বুটে কোনো সমস্যা তৈরি হয়েছিল। নিজ হাঁটুর ওপর ইয়ামালের বাঁ পা রেখে বুটটি পরিস্কার করার পাশাপাশি সতীর্থের জন্য নতুন এক জোড়া বুটও চান ডাগআউটে। কিন্তু ইয়ামাল রাজি হননি। প্রথমার্ধ ওই বুট জোড়া দিয়েই খেলেন।

কতটা অসাধারণ, সেটা বুঝিয়ে দিচ্ছে পরিসংখ্যান। ফক্স সকার জানিয়েছে, ১৭ বছর ২৪১ দিন বয়সে ইয়ামাল বার্সার হয়ে এ পর্যন্ত ৮৮ ম্যাচ খেলে ১৯ গোল করেছেন। গোল বানিয়েছেন ২৪টি। আর স্পেনের হয়ে ১৭ ম্যাচে করেছেন ৩ গোল। বানিয়েছেন আরও ৮ গোল। এর মধ্যে জিতেছেন ইউরো, সেরা গোলের পুরস্কার পাওয়ার পাশাপাশি হয়েছেন ইউরোর সেরা খেলোয়াড়ও। মেসি ১৭ বছর বয়সে বার্সার হয়ে ৯ ম্যাচে করেছিলেন ১ গোল। গোল বানানোর খাতা তখনো খোলেননি। আর্জেন্টিনার হয়েও অভিষেক হয়নি।

হ্যাঁ, ইয়ামালের শুরুটা মেসির থেকেও ভালো। কিন্তু মেসি দিনে দিনে যা হয়েছেন, এখন ইয়ামালের সামনে সেই চ্যালেঞ্জটাই। পথেই আছেন। এ মৌসুমে ৩৬ ম্যাচে ১২ গোলের পাশাপাশি বানিয়েছেন ১৭ গোল। বার্সায় একসময় গোল করার পাশাপাশি গোল বানানোই ছিল মেসির কাজ। সেই গুণাবলিও পেয়েছেন ইয়ামাল। শুরুতেই দেওয়া উপমাটা আর না-ই মনে করিয়ে দিই!