৪৩৪ রানও যেদিন কম হয়েছিল
ওয়ানডেতে দলীয় ৪০০ রান এখন আর কোনো বিষয় নয়। স্কোরবোর্ডের বাঁ পাশে ‘৪’ রেখে তিন অঙ্কের ওই সংখ্যা দেখে আর ভ্রুকুটি জাগে না। কিন্তু একটা সময় ছিল যখন ৩০০ রান দেখেও চোখে বিষ্ময় জেগেছে। সেই রান তাড়া করে জিতলে তো কথাই নেই। ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে তা কয়েক দিনের আলোচনার খোরাক।
এখন অবশ্য যেকোনো রানপাহাড় টপকে জিতলেও সেভাবে কেউ গা করে না। তবে ৪০০ রান ক্যাটাগরিতেই এমন এক ম্যাচ আছে, যার বয়স প্রায় দুই দশক হয়ে গেলেও লোকে মনে রেখেছে। এখন কোনো দল ৪০০ তুললেও ওই ম্যাচের প্রসঙ্গ ওঠে। ধরতে পেরেছেন কোন ম্যাচ? সময় বলে দেওয়ায় নিশ্চয়ই মনে পড়েছে!
যেহেতু মনে পড়েছে, তাই ওই প্রসঙ্গে একটু পরে আসি। আগে একটি বিষয় ভেঙে বলা যাক। বলুন তো, ওয়ানডেতে প্রথম দলীয় ২০০ রান কবে হয়েছে? সেটা ১৯৭২ সালের ২৪ আগস্ট ইতিহাসের দ্বিতীয় ওয়ানডেতেই। প্রথমবারের মতো ২০০ রান তাড়া করে জয়ও ইংল্যান্ড–অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার সে ম্যাচে।
প্রথম ৩০০? তিন বছর পর প্রথম বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে আর ওয়ানডের হিসাবে ১৯তম ম্যাচ। ভারতের বিপক্ষে ৪ উইকেটে ৩৩৪ রান তুলেছিল ইংল্যান্ড।
২৮ বলে ১৫ ছক্কায় ১০১—অস্ত্র জমা দিলেও ট্রেনিং জমা দেননি ডি ভিলিয়ার্সকিন্তু প্রথম ৩০০ রান তাড়া করে জয় কবে? ওয়ানডে ক্রিকেট প্রথম ৩০০ রানের দলীয় স্কোর দেখার ১৭ বছর পর এবং সেটাও বিশ্বকাপেই! ১৯৯২ বিশ্বকাপে জিম্বাবুয়ের ৩১২ রান তাড়া করে জিতেছিল শ্রীলঙ্কা। সেটা ছিল ৭১৬তম ওয়ানডে।
এবার প্রথম ৪০০–এর প্রসঙ্গে আসা যাক। ওয়ানডেতে প্রথম দলীয় ৪০০ রান এবং সেটা তাড়া করে জয়ও একই ম্যাচেই।
প্রথম ৩০০ রান তাড়া করে জয়ের ১৪ বছর পর দেখা গেল ৪০০ রান তাড়া করে জয়। যে ম্যাচের প্রতিবেদনে ক্রিকইনফোর শিরোনাম ছিল, ‘সাউথ আফ্রিকা উইন দ্য গ্রেটেস্ট ম্যাচ অব অল’। অনেকেই সে ম্যাচের স্মৃতি টেনে হয়তো মনে করার চেষ্টা করেন, ‘সেদিন আমি কোথায় ছিলাম!’
১২ মার্চ ২০০৬।
আন্তর্জাতিক টি–টোয়েন্টি কেবল হাঁটি হাঁটি পা পা করছে। সবে ছয়টি ম্যাচ হয়েছে। তখনকার ওয়ানডেতে যদি দেখেন, দুই দলের কয়েকজনের ব্যাটিং স্ট্রাইকরেট ১৫০–এর ওপরে। ওভারপ্রতি রান রেট সাড়ে আটের বেশি। একজন ছাড়া দুই দল মিলিয়ে মোট ১৩ জন বোলারের ইকোনমি রেট ৭–এর নিচে নামেনি; তাহলে কী মনে হবে?
অস্ট্রেলিয়া ৫০ ওভারে ৪ উইকেটে ৪৩৪ তুলে থামার পর দক্ষিণ আফ্রিকার ড্রেসিংরুমে মৃত্যুর মতো নীরবতা ভর করেছিল। কিন্তু জ্যাক ক্যালিস বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয় ওরা ১০–১৫ রান কম করেছে।’
ব্যাপার অনেকটাই এমন যে ১৯ বছর আগেই কারও কারও হাতে শোভা পাচ্ছে ফ্ল্যাগশিপ স্মার্টফোন। ভিডিও কল করার পাশাপাশি টাচস্ক্রিন এবং প্রযুক্তিগত প্রায় যেকোনো কিছুই করা সম্ভব হচ্ছে। অবশ্যই সেটা মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো।
হ্যাঁ, ৪৩৪ রান তাড়া করে জয়ের সেই ওয়ানডে তখনকার সময়ের চেয়ে এগিয়ে ছিল।
সেটা ছিল পাঁচ ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের শেষ ম্যাচ। সিরিজ নির্ধারণী ম্যাচও।
জোহানেসবার্গের ফ্ল্যাট পিচে অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক রিকি পন্টিং টস জিতে আগে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন। পন্টিং নিজে ১৫৬.১৯ স্ট্রাইকরেটে ১০৫ বলে খেলেন ১৬৪ রানের ইনিংস। তিনটি ফিফটি আসে অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, সাইমন ক্যাটিচ ও মাইক হাসির ব্যাট থেকে। সব ইনিংসেরই স্ট্রাইকরেট ছিল ১২০–এর ওপরে।
হাসির ৫১ বলে ৮১ রানের (১৫৮.৮২) ইনিংসটি শুরু হয়েছিল ৩১তম ওভারে; অস্ট্রেলিয়ার স্কোর যখন ২ উইকেটে ২১৬। পন্টিংয়ের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ‘আমিও কি মেরে খেলা শুরু করব?’ পন্টিং কী বলেছিলেন শুনুন হাসির মুখেই, ‘পূর্ণ স্বাধীনতা আছে। সেজন্য দ্রুত আউট হলেও সমস্যা নেই।’
অস্ট্রেলিয়া ৫০ ওভারে ৪ উইকেটে ৪৩৪ তুলে থামার পর শন পোলকের ভাষায় দক্ষিণ আফ্রিকার ড্রেসিংরুমে মৃত্যুর মতো নীরবতা ভর করেছিল, ‘ইনিংস বিরতিতে ওরা ফেরার পর ড্রেসিংরুমে মৃত্যুপ্রতিম নীরবতা নেমে এসেছিল। সবাই খুব হতাশ। জ্যাক ক্যালিস একটু দেরিতে ড্রেসিংরুমে ঢুকে বলল, বোলাররা তাদের দায়িত্ব পালন করেছে—আমার মনে হয় ওরা ১০–১৫ রান কম করেছে।’
ক্যালিস মজা করলেও সেটা আসলে মনোবল ফেরানোর টনিক ছিল। কারণ, তখন ৪০০ রান তাড়া করে জেতার ভাবনাটা শুধু স্বপ্নেই সম্ভব মনে হতো। মার্ক বাউচারের ভাষায়, ‘ক্যালিস এমনিতে কম কথা বললেও সে বরফশীতল নীরবতা ভাঙার পর সবাই হাসতে শুরু করল। আমরা বুঝেছিলাম, আজ অবিশ্বাস্য ক্রিকেট খেলতে হবে।’
সেই অবিশ্বাস্য ব্যাটিংয়ের মধ্যমণি ছিলেন এমন একজন, যাঁকে ম্যাচের আগের রাতে টিম হোটেলে মদ্যপানের কারণে প্রোটিয়া অধিনায়ক গ্রায়েম স্মিথ দল থেকে বাদ দিতে চেয়েছিলেন। এ ম্যাচে তাঁর খেলার কথা ছিল না।
টি–টোয়েন্টিতে ২৫৮ রান করেও হার—ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়ক বললেন, ‘অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি’হাসির ভাষায়, ‘আমরা একই হোটেলে ছিলাম। ডিনারে যাওয়ার সময় দেখলাম, হার্শেল গিবস বারে বসে আছে। প্রায় দুই ঘণ্টা পর ফেরার সময়ও দেখি সে ওখানেই বসে। ঘুমাতে যাওয়ার সময়ও দেখি একই জায়গায় বসে।’ হাসিই পরে জানিয়েছেন, প্রোটিয়াদের কোচ মিকি আর্থার ও অধিনায়ক স্মিথ আগের রাতে ওই কাণ্ডের কারণে গিবসকে দল থেকে বাদ দিতে চেয়েছিলেন; কিন্তু বিকল্প ব্যাটসম্যান ছিল না।
অতএব গিবস খেললেন এবং শুধু কি খেললেন! ১১১ বলে ১৫৭.৬৫ স্ট্রাইকরেটে ১৭৫ রানের ম্যাচ জেতানো এক ইনিংস। সঙ্গে স্মিথের ৫৫ বলে ৯০। আর বাউচার ৪৩ বলে ৫০ রানে শেষ পর্যন্ত ছিলেন ক্রিজে।
জয়ের জন্য শেষ ওভারে দরকার ছিল ৭ রান। অ্যান্ড্রু হল প্রথম দুই বলে বাউন্ডারিসহ ৫ রান তুলে নেওয়ার পরের বলে আউট। চতুর্থ বলে এনটিনি ১ রান নেওয়ার পর পঞ্চম বলে চার মেরে অবিশ্বাস্য রূপকথার মতো এক জয় নিশ্চিত করেন বাউচার। দক্ষিণ আফ্রিকাও সিরিজটি ৩–২ ব্যবধানে জিতে নেয়।
কিন্তু সেই জয় ছাপিয়ে সেদিন যে রূপকথার জন্ম হয়েছিল তার নাম হতে পারে ৮৭২। দুই দল মিলিয়ে ওয়ানডেতে এত রান আজও পর্যন্ত কোনো ম্যাচে দেখা যায়নি!
এনটিনি যে ১টি রান নিয়েছিলেন পোলকের ভাষায় সেটি ‘তার ক্যারিয়ারের সেরা সিঙ্গেল।’ আর গিবস? তাঁর ওই ইনিংসের চরিত্রটি গিবসের ব্যক্তিত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করেছিলেন পোলক, ‘সে কিছু করলে সেটা সব সময়ই বড়সড় হয়। রাতে বারে গেলে উঠে আসার নাম করে না। কেএফসিতে গেলে বাকেট নিয়ে বসবে। এটাই গিবসের ব্যক্তিত্ব। কিছু করলে বড়সড়, না করলে নেই।’
স্পিনে সব ওভার, স্পিনে সব উইকেট: ক্রিকেটে নতুন বিশ্ব রেকর্ডএনটিনি অবশ্য রাখঢাক রাখেননি, ‘হার্শেল হচ্ছে চিরকালীন সতেজ মানুষ। এমনকি সেদিন সবার সামনেই বলেছিলাম, প্রতি রাতেই হার্শেলকে মদ পান করতে দেওয়া উচিত!’
আসলে খেলেছিল অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা। খেলেছিল ওরা ২২ জন। ঝড় উঠেছিল স্কোরবোর্ডে। আর মাতাল হয়েছিলেন দর্শক। সেই মাতলামি কাটেনি আজও!
নইলে আজও কেন সেই ম্যাচ স্মরণ? কারণটা কিন্তু দিন–তারিখ উল্লেখ করে আগেই বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। আজ সেই দিন, যেদিন অস্ট্রেলিয়ার ৪৩৪ রানও দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য কম হয়ে গিয়েছিল!