সারা রাত খুঁটিতে ভর দিয়ে ছেলের লাশের অপেক্ষায় বাবা
করাতকলে (স মিল) সামান্য বেতনের চাকরি করে ছেলেকে প্রকৌশলী বানিয়েছেন। চাকরিও পেয়েছিলেন প্রকৌশলী ছেলে। বাবা জহুর আহমেদ (৬৫) স্বপ্ন দেখছিলেন সচ্ছলতার। কিন্তু ছেলেকে ঘিরে তাঁর সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে। সুখ–স্বাচ্ছন্দ্যের সব আশা গুঁড়িয়ে দিয়ে এল আদরের ছেলে মো. সোলাইমানের লাশ।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে একটি কারখানার প্রকৌশলী মো. সোলাইমান (৩৩) গতকাল বুধবার বিকেল পাঁচটার দিকে একটি লরির চাপায় নিহত হন। ঘটনাস্থলেই নিহত এই প্রকৌশলীর লাশ ময়নাতদন্তের জন্য রাতেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। আজ বৃহস্পতিবার সকালে ময়নাতদন্তের পর লাশ আনা হয় চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার ভাটিয়ারী ইউনিয়নের ভাটিয়ারী উত্তর বাজার এলাকায় নিহতের বাড়িতে। আর নিহত ছেলের অপেক্ষায় বাড়ির সামনে একটি খুঁটিতে ভর দিয়ে সারা রাত অপেক্ষায় ছিলেন বাবা জহুর আহমেদ। বাড়ির লোকজন-আত্মীয়স্বজন বুঝিয়েও তাঁকে ঘরে নিয়ে যেতে পারেননি।
আজ সকাল সাড়ে আটটার দিকে ভাটিয়ারীর উত্তর বাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির সামনে দোকানের একটি খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে আছেন জহুর আহমেদ। সোলাইমানের লাশ তখনো আসেনি। জানালেন, ছেলেকে দেখে ঘরে ফিরবেন তিনি। বিষণ্ন মুখ, শূন্য দৃষ্টি। রাস্তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ছেলে আসবে। তাই দাঁড়িয়ে আছি।’ খবরটা শোনার পর থেকে সারা রাত সেখানেই ছিলেন জহুর আহমেদ।
পুলিশ জানিয়েছে, একই মালিকানাধীন কেএসআরএম ও রয়েল সিমেন্ট পাশাপাশি দুটি কারখানা। প্রকৌশলী সোলাইমান চাকরি করতেন রয়েল সিমেন্ট কারখানায়। কিন্তু কারখানাটির পাওয়ার প্ল্যান্ট ছিল কেএসআরএম কারখানার ভেতরে। ওই পাওয়ার প্ল্যান্টে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেওয়ায় তা মেরামত করতে যান সোলাইমান। কাজ শেষে তিনি কেএসআরএম কারখানার থেকে বের হয়ে নিজের কারখানায় ফিরে আসছিলেন। এ সময় রডবোঝাই একটি লরি পেছনের দিকে এসে তাঁকে চাপা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান। পরে কারখানা কর্তৃপক্ষ লাশ উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। এরপর লাশ ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালটির মর্গে রাখা হয়।
জহুর আহমেদের তিন ছেলের মধ্যে সোলাইমান সবার ছোট। অভাব–অনটনের কারণে বড় দুই ছেলেকে ভালোভাবে পড়াশোনা করাতে পারেননি। অনেক কষ্টে ছোট ছেলে সোলাইমানকে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করিয়েছিলেন।
জহুর বলেন, নিজের এলাকায় একটি স মিলে কাজ করে অতি কষ্টে ছেলেদের বড় করেছেন। সোলাইমান অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। যার কারণে সংসারের অভাব–অনটনের পরও তাঁকে পড়াশোনা করিয়েছেন। বানিয়েছেন প্রকৌশলী। স্বপ্ন ছিল একটা ছেলে অন্তত মানুষের মতো মানুষ হবেন। সংসারের অভাব–অনটনও ঘুচে যাবে। ছেলের চাকরি হয়েছে। কিন্তু সচ্ছলতার মুখ দেখার আগেই ছেলে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন।
জহুর আহমেদ আরও বলেন, ৩৩ বছর বয়স হয়ে গেছে ছেলের। বহুদিন ধরে চেষ্টা করেছেন তাঁকে বিয়ে করাতে। শেষে রাজিও হয়েছিলেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ হলো না।
সোলাইমানের বড় ভাই জাফর ইকবাল প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ছোট ভাই বাঁচতে চেয়েছিলেন। গাড়ি ধাক্কা দেওয়ার মুহূর্তে হাত দিয়ে ঠেলে ধরতে চেয়েছিলেন; কিন্তু পারেননি। তাঁর হাতের আঙুল ও মাথার পেছনের অংশ থেঁতলে দিয়েছে লরি।
জাফর ইকবাল বলেন, কোরবানির ঈদের পর সোলাইমানকে বিয়ে করানোর কথা ছিল। মেয়ে দেখা হচ্ছিল। কিন্তু তা আর করানো গেল না।
সীতাকুণ্ড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, রডবোঝাই একটি লরির চাপায় প্রকৌশলী সোলাইমান নিহত হয়েছেন। নিহতের পরিবারের সদস্যদের খবর দেওয়া হয়েছে। লাশের ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ঘটনায় সীতাকুণ্ড থানায় একটি মামলা হয়েছে।