Advertisement
  • হোম
  • বাণিজ্য
  • মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের তদবিরের স্থলবন্দরগুলোর ভবিষ্...

মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের তদবিরের স্থলবন্দরগুলোর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত

প্রকাশ: ২১ নভেম্বর, ২০২৪

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রভাবশালী মন্ত্রী ও আমলাদের সুপারিশে নেওয়া আটটি স্থলবন্দরের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে তাঁরা নিজ নিজ এলাকায় অপ্রয়োজনীয় এসব স্থলবন্দর তৈরি করেছেন। এর জন্য শত শত কোটি টাকা খরচ করে অবকাঠামোও নির্মাণ করা হয়। কিন্তু এসব স্থলবন্দর দিয়ে আশানুরূপ কোনো বাণিজ্য হয় না। রাজনীতিবিদ ও প্রভাবশালীদের ইচ্ছাপূরণের এসব স্থলবন্দর রাখা হবে, নাকি বাতিল করা হবে—সেই বিষয়ে কাজ শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।

যেসব স্থলবন্দরের বিষয়ে সরকার পর্যালোচনা শুরু করেছে সেগুলো হলো শেরপুরের নাকুগাঁও, ময়মনসিংহের গোবরাকূরা-কড়ইতলি; জামালপুলের ধানুয়াকামালপুর, হবিগঞ্জের বাল্লা, দিনাজপুরের বিরল, নীলফামারীর চিলাহাটি, চুয়াডাঙ্গার দৌলতগঞ্জ ও রাঙামাটির তেগামুখ। এসব স্থলবন্দরের কোনোটিতে কার্যক্রম নেই। আবার কোনোটিতে কার্যক্রম থাকলেও তা অলাভজনক।

দেশজুড়ে ২৪টি স্থলবন্দর থাকলেও পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর হিসেবে ১২টির কার্যক্রম চালু আছে। বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ (বাস্থবক) এই বন্দরগুলো পরিচালনা করে। পর্যাপ্ত অবকাঠামো না থাকায় বাকিগুলোর কার্যক্রম চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। মূলত পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে স্থলপথে বাণিজ্য সহজ করার জন্য স্থলবন্দরগুলোর অবকাঠামো উন্নয়ন করা হয়।

কয়েক দিন আগে আটটি স্থলবন্দরের ভবিষ্যৎ নিয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (বাস্থবক) মুন্সী মো. মুনীরুজ্জামানের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির কার্যপরিধিতে বলা হয়, কমিটির সদস্যরা এক মাসের মধ্যে স্থলবন্দরগুলো পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দেবেন। সেখানে কোন স্থলবন্দর রাখা যায়, কোনটি বাদ দেওয়া যায়, সেই সুপারিশ থাকবে।

কোনো স্থলবন্দরই রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া উচিত নয়। অর্থনৈতিক মূল্যায়নের ভিত্তিতেই স্থলবন্দর চালু করা দরকার। কারণ, ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্ভাবনাও বিবেচনায় নিতে হবে
জাহিদ হোসেন, সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কোনো স্থলবন্দরই রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া উচিত নয়। অর্থনৈতিক মূল্যায়নের ভিত্তিতেই স্থলবন্দর চালু করা দরকার। কারণ, ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্ভাবনাও বিবেচনায় নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, স্থলবন্দর বন্ধের ক্ষেত্রে বাণিজ্যের পরিমাণ কত এবং কত বিনিয়োগ হয়েছে—এসব বিবেচনায় নেওয়া দরকার।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, মূলত নিজের এলাকার মানুষকে খুশি করতেই প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিরা বিভিন্ন স্থলবন্দর করেছেন। সীমান্ত এলাকায় স্থলবন্দর ঘোষণা দেওয়া হলে স্থানীয় রাজনীতিতে বিশেষ সুবিধা বা সহমর্মিতা পাওয়া যায়। এ জন্য বিগত সরকারের আমলে প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিরা তদবির করে কিছু স্থলবন্দর প্রতিষ্ঠা করেন। এ ছাড়া স্থলবন্দরের অবকাঠামো উন্নয়নে প্রকল্প নেওয়ায় বেশি আগ্রহ দেখান প্রভাবশালীরা।

কোন মন্ত্রীর সুপারিশে কোন স্থলবন্দর

২০১৫ সালে শেরপুরের নাকুগাঁও স্থলবন্দর কার্যক্রম শুরু করে। এই স্থলবন্দরটির জন্য গত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক কৃষিমন্ত্রী সদ্য প্রয়াত মতিয়া চৌধুরী সুপারিশ করেন। তাঁর সুপারিশেই মূলত এই স্থলবন্দর ঘোষণা করা হয়। শেরপুর জেলা সদর থেকে নাকুগাঁও স্থলবন্দরে যাওয়ার ২৯ কিলোমিটার সড়ক তখন খুবই সরু ও আঁকাবাঁকা ছিল। পণ্যবাহী ট্রাক চলাচলের অনুপযোগী ছিল। অপর প্রান্তে ভারতের ডালু শুল্ক স্টেশনেও কোনো অবকাঠামো ছিল না। সামান্য কিছু বাণিজ্য হতো। তবে এই শুল্ক স্টেশনটি স্থলবন্দরে রূপান্তরের বিপক্ষে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ ও এনবিআরের আপত্তি টেকেনি। অবকাঠামো উন্নয়নে বিপুল অর্থ খরচ করা হয়। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে মাত্র ১৫০ টন পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়েছে এই স্থলবন্দর দিয়ে।

২০১০ সালে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট এলাকায় গোবরাকূরা-কড়ইতলি স্থলবন্দর ঘোষণা করা হয়। আওয়ামী লীগের সাবেক সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী প্রয়াত প্রমোদ মানকিন এই স্থলবন্দরের জন্য সুপারিশ করেন। এটি আসলে নজিরবিহীন স্থলবন্দর। পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে গোবরাকূরা ও কড়ইতলি দুটি স্থলবন্দর নির্মাণ করা হয়। ২০২২ সালে এই স্থলবন্দরের যাবতীয় অবকাঠামো নির্মাণ করে উদ্বোধন করা হয়। গত অর্থবছরে এই স্থলবন্দর দিয়ে কোনো পণ্যের চালান আসা-যাওয়া করেনি।

সাবেক পাট ও বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজমের তদবিরে ২০১৫ সালে জামালপুরের ধানুয়াকামালপুর স্থলবন্দরের ঘোষণা দেওয়া হয়। এ ছাড়া এই স্থলবন্দরের উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়ার জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ সুপারিশ করেন। ২০২৩ সালে এই স্থলবন্দরের উদ্বোধন হয়। গত অর্থবছরে এই স্থলবন্দর দিয়ে মাত্র ১৩২ টন মালামাল আসা-যাওয়া করেছে।

সাবেক নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী নিজের এলাকায় দিনাজপুরে বিরল স্থলবন্দর ঘোষণা দেন। এটি এখনো চালু হয়নি।

এ ছাড়া গত সরকারের প্রভাবশালী আমলা অশোক মাধব রায় ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিবের দায়িত্ব পান। অশোক মাধব রায়ের বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার শায়েস্তাগঞ্জে। তিনি সচিবের দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই ২০১৬ সালে ২৩ মার্চ বাল্লা শুল্ক স্টেশনকে স্থলবন্দর ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপরই স্থলবন্দরের অবকাঠামো উন্নয়নে ৪৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা খরচ করে ভবন, ইয়ার্ড, ওজনযন্ত্রসহ নানা অবকাঠামো তৈরি করে। কিন্তু সীমান্তের ওপারে ভারতের দিকে কোনো প্রকল্প নেই। তাই এই স্থলবন্দরটি অকার্যকর অবস্থায় আছে।

২০১৩ সালে নীলফামারীর সাবেক সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের অনুরোধে চিলাহাটি শুল্ক স্টেশনকে স্থলবন্দর ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু ভারতের অংশের কুচবিহারের হলদিবাড়ি এলাকায় কোনো শুল্ক স্টেশন না থাকায় নামেই এটি শুধু স্থলবন্দর।

চুয়াডাঙ্গার জীবননগরের দৌলতগঞ্জ স্থলবন্দরের জন্য স্থানীয় আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য তদবির করেছিলেন। এ ছাড়া রাঙামাটির বরকলের তেগামুখ স্থলবন্দর ঘোষণা দেওয়া হয় পুরোপুরি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। এই দুটি স্থলবন্দরের কোনোটিই চালু হয়নি।

পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে বিশেষ করে ভারতসহ পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে বাণিজ্য সহজ করতে ২০০১ সালে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়। স্থলবন্দরের আয়ের প্রধান উৎসগুলো হলো খালাস হওয়ার অপেক্ষায় থাকা পণ্যের জন্য শেড ও ইয়ার্ড ভাড়া, ওজন মাপার মাশুল, প্রবেশ মাশুল, শ্রমিক মজুরি, দলিলাদি প্রক্রিয়াকরণ মাশুল ইত্যাদি।

Lading . . .