‘চান্দা দেওন লাগে না, এর লাইগ্যা সবজির দাম কইম্যা গেছে’
প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর, ২০২৪
‘১৫ বছর ধইরা নিমসার বাজারে সবজির ব্যবসা করতাছি। এমন কোনো দিন নাই যে খাজনা আর চান্দা দেওন লাগছে না। গতকাইল (রোববার) প্রশাসনের লোক আইয়া কইলো এহন থ্যাইক্কা আর খাজনা দেওন লাগত না। এমন কথা হুইন্না আমরা তো অবাক। ঠিকই গতকাইলও খাজনা দেওন লাগে নাই আর আইজকাও কেউ টেকা তুলতো আইছে না। চান্দা দেওন লাগে না, এর লাইগ্যা আইজ দুই দিন ধইরা সবজির দাম কমতাছে। পরশুদিনও বেগুন বেচ্ছি ৫০ টেকা, আজকা বেচতাছি ৩০–৩৫ টেকা। এই অবস্থা থাকলে মাইনসে অনেক কম দামে সবজি খাইতারবো।’
আজ সোমবার সকাল সাড়ে আটটার দিকে দেশের অন্যতম বৃহৎ শাকসবজির পাইকারি বাজার কুমিল্লার নিমসারে কথাগুলো বলছিলেন পাইকারি সবজি ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম। তিনি এই বাজারে খোলা স্থানে দীর্ঘ দেড় দশকের বেশি সময় ধরে শাকসবজির ব্যবসা করছেন। প্রতিদিনই এখানে ব্যবসা করার জন্য তাঁকে খাজনার নামে চাঁদা দিতে হতো। শুধু রফিকুলই নয়, তিনি যে ব্যাপারীর কাছ থেকে সবজি কেনেন এবং যাঁর কাছে পাইকারি বিক্রি করতেন—তাঁদেরও ট্রাক বা পিকআপপ্রতি ৬০০ টাকা থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত টোলের নামে চাঁদা দিতে হতো। এভাবে একই পণ্যে তিনবার চাঁদা আদায় হতো নিমসার বাজারে, যার প্রভাব পড়ত খুচরা বাজারে।
গতকাল রোববার সকালে নিমসার বাজারে অভিযান চালিয়েছে জেলায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে গঠিত টাস্কফোর্স। এ সময় দেশের অন্যতম বৃহৎ এই শাকসবজিসহ কাঁচাবাজারে ইজারা আদায় ও চাঁদাবাজি বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এরই মধ্যে এই সিদ্ধান্তের সুফল মিলতে শুরু করেছে। পাইকারি থেকে খুচরা পর্যায়ে কমতে শুরু করেছে শাকসবজির দাম।
আজ সকাল ৮টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত নিমসার বাজার ঘুরে অন্যান্য দিনের তুলনায় শাকসবজির দামে ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক লাগোয়া জেলার বুড়িচং উপজেলার এ বাজার থেকেই শাকসবজিসহ বিভিন্ন কাঁচামাল নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করছেন পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা। কাঁচা মরিচ পাইকারিতে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১৩০ টাকা, শসা ৩৭ থেকে ৪০ টাকা, শিম ১০০ থেকে ১২০ টাকা, মুলা ২০ টাকা, জলপাই ৪০ টাকা, বরবটি ৪০ থেকে ৪৫ টাকা, করলা ৪০-৪৫ টাকা, চিচিঙ্গা ৩০-৩৫ টাকা, পটোল ৩৫-৪০ টাকা, লাউ ২০ পিসের বস্তা ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা, ফুলকপি ৪৫-৫০ টাকা, ধুন্দুল ৩৫ টাকা, জালিকুমড়া ৩৫-৪০ টাকা, কাঁকরোল ৬০-৭০ টাকা, আলু ৫০-৫২ টাকা। এ ছাড়া অন্যান্য শাকসবজির দামও অনেকটা নাগালে মধ্যে পাইকারি দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে। যদিও গত শনিবারও এসব সবজির দাম পাইকারিতে ১০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত বেশি দরে বিক্রি হয়েছে কেজি প্রতি। নিমসারে দাম নিয়ন্ত্রণে থাকায় কুমিল্লা নগরের কাঁচাবাজারেও এর ইতিবাচক প্রভাব দেখা গেছে।
বাজারে পুঁইশাক বিক্রির সময় কথা হয় স্থানীয় কৃষক আবদুল ওয়াদুদের সঙ্গে। চাঁদা দিতে হয়নি বলে তাঁর চোখেমুখে স্বস্তির ছাপ দেখা যাচ্ছিল। তিনি বলেন, ‘প্রতি আঁটি পুঁইশাক আজকা ২০ টেকা কইরা বেচতাছি। পরশুদিন বেচ্ছি ৩০ টেকা। কারণ, প্রত্যেক আঁটি থাইক্কা তারারে কম কইরা ৫ টেকা দেওন লাগত। কয়েক দিন আগে শাপলা বেচ্ছিলাম। আমি বিলেরতে তুইল্লা আইনা এত কষ্ট কইরা পাইতাম ১৫ টেকা আঁটি। আর তারারে দেওন লাগত ১০ টেকা। যার লাইগ্যা প্রতি আঁটি বেচতাম ২৫ টেকা। আমরা এহন খুশিতে আছি। আর চান্দা দিতাম চাই না।’
বাজারের শাকসবজি নিয়ে আসা কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগে ইজারাদারেরা বেশি অত্যাচার করেছে কৃষকসহ অস্থায়ী ব্যবসায়ীদের ওপর। আড়তদার, পাইকারি ব্যবসায়ী ও ব্যাপারীদের চাঁদা বা ইজারা ছিল নির্ধারিত। কিন্তু কৃষকসহ অস্থায়ী ব্যবসায়ীরা আসলে অনেক বেশি চাঁদা আদায় করা হতো।
জেলার চান্দিনা উপজেলার নবাবপুর বাজার থেকে পিকআপ নিয়ে সোমবার সকালে নিমসারে এসেছেন পাইকারি ক্রেতা জামাল হোসেন। কিন্তু অন্যান্য দিনের মতো টাকা উত্তোলনকারীদের না দেখে অনেকটাই অবাক হয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আগে ছোট্ট এক টনের পিকআপে এক বস্তা মাল তুললেই ৫৫০-৬০০ টাকা টোল দিতে হতো। এ ছাড়া আরও বিভিন্নভাবে তারা চাঁদা নিত। আর বড় ট্রাক হলে নিত ১ হাজার ২০০ টাকা। এখন চাঁদাবাজি বন্ধ থাকায় মালের দাম কিছুটা কম। আমরাও এলাকায় গিয়ে কম দামেই বিক্রি করব।’
বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী খোরশেদ আলম, ফরিদ হোসেন, আবুল কাশেম, সাইফুল ইসলামসহ অন্তত ১০ জন বলেন, চাঁদাবাজি না থাকলে এভাবে শাকসবজির দাম বাড়ত না। ইজারা ও টোলের নামে চাঁদা উত্তোলনকারীরা সংঘবদ্ধ। তাঁরা যেকোনো সময় আবারও এসে চাঁদাবাজি শুরু করতে পারেন। এ জন্য প্রশাসনকে বাজার মনিটরিং অব্যাহত রাখতে হবে। কারণ, নিমসার বাজারের শাকসবজির দামের ওপর শুধু কুমিল্লা নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানের খুচরা বাজার নিয়ন্ত্রিত হয়। এখানে দাম স্বাভাবিক থাকলে খুচরা পর্যায়ে সুফল পাবেন ক্রেতারা।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের (কুমিল্লা) সহকারী পরিচালক মো. আছাদুল ইসলাম বলেন, দেশের অন্যতম বৃহৎ শাকসবজির পাইকারি বাজার নিমসারে খাজনা ও চাঁদা আদায় বন্ধ হওয়ার সুফল আজ খুচরা বাজারগুলোতেও দেখা গেছে। যে কাঁচা মরিচ দুই দিন আগেও ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হতো, খুচরা পর্যায়ে সেটি আজ ১৫০ থেকে ১৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এভাবে সব সবজির দামই কমে এসেছে। খুচরা ও ভোক্তা পর্যায়ে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।